Saturday 16 May 2020

আমার কিছু ব্যক্তিগত সম্পত্তি














 

 

 

প্রথমে সেইসব বরফটুকরোর প্রসঙ্গে আসা যাক;
ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় আমি ওগুলোকে পেয়েছিলাম-
বকুলপুরের মাঠে খেলতে গিয়ে বল লাগা চোটের ওপর
নরম আদরে ওগুলোকে বুলিয়ে দিয়েছিলেন
মাঠের পাশের বাড়ির নাম-না-জানা-গোলগাল-মহিলা
পরে আমি সেগুলোকে অবলীলায় বেচে দিয়েছি।


এরপর আসবে সেই সিগারেটটার কথা;
সঞ্জীবদের বাড়ির পাঁচিলটার আড়ালে, সন্তর্পণে
সদ্য গোঁফ ওঠা ঠোঁটে যেটা চেপে ধরতেই
সাইকেল থেকে লাফ দিয়ে নেমে এসে
পাশের পাড়ার গোপালকাকা,
আমাকে কান ধরে হিড়হিড় করে নিয়ে গেলেন
আমার বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে;
অবশ্য বলতে হবে সেই সিগারেট টুকরোটা বিক্রি করে
খুব বেশি টাকা পাওয়া যায়নি।


তারপর সেইসব অমোঘ জলকণা থাকবে;
এসপ্ল্যানেড থেকে মৌলালি-
বৃষ্টি পড়েছিল শুধু আমাদের উদ্দেশ্যে;
নীলামে, সরিতা আর আমার গায়ে ঝরে পড়া
বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর দাম উঠেছিল চড়চড় করে।


কিন্তু মুশকিল হল এইভাবে বেচতে বেচতে,
আমি প্রায় সবকিছু বেচে ফেলেছি।
এখন আমার কাছে পড়ে রয়েছে
শুধু বাপ ঠাকুরদার আমলের একটা হাঁসুয়া-
যদি তাতে বিস্তর জং ধরে গেছে।


(কী বলছেন? এই পেনটা? যেটা দিয়ে কবিতা লিখছি?
ও হ্যাঁ হ্যাঁ! মাফ করবেন, ওটাও পড়ে আছে বটে!
ওটাকেও হিসেবের মধ্যে ধরে নিন)।


ফলে ঠিক করেছি, এগুলোকে আমি
আর কিছুতেই বিক্রি করব না, অনেক টাকা দিলে না।
যতটা টাকা থাকলে বউকে উড়োজাহাজ, টর্পেডো কিম্বা
বুলডোজার কিনে দেওয়া যায়,
যতটা টাকা থাকলে আনন্দবাজারে ছবি বেরয়,
যতটা টাকা থাকলে শিল্পবোদ্ধা হওয়া যায়,
কিংবা যতটা টাকা থাকলে জনগণকে সেবা আর
শিশুগণকে হত্যা করা যায়-
ততটা টাকা থাকলেও কেউ এগুলোকে
আমার কাছ থেকে কিনে নিতে পারবে না।


আমি শুধু বিনিময় প্রথায় রাজি আছি!
প্রত্যেক ঘর থেকে ভেসে আসা ভাতের গন্ধের,
বা একসঙ্গে অসংখ্য নানা রংয়ের শিশুর
হাসিমুখের বিনিময়ে আমি অনায়াসে
হাঁসুয়াটাকে দিয়ে দিতে পারি।


অবশ্য পেনটাকে আমি তখনও ছেড়ে দেব না;
ব্যক্তিগত  সম্পত্তি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও না!
তখনও আমি পেনটাকে ভেতরের বুকপকেটে
যত্ন করে লুকিয়ে রেখে দেব।
ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তির যুগে,
ওটাই হবে আমার শেষ ব্যক্তিগত সম্পত্তি।  

[বিকল্প পত্রিকায় প্রকাশিত]

ফটো সূত্রঃ https://fineartamerica.com/featured/fountain-pen-sketch-martina-fagan.html

Wednesday 13 May 2020

অনুবাদঃ নাসদীয় সুক্ত ( ঋকবেদ, দশম মণ্ডল, ১২৯ সংখ্যক সুক্ত)



















তখন অস্তিত্ব ছিল না, অনস্তিত্বও না
বাতাস ছিল না, বাতাসের ওপারে মহাকাশ ছিল না 
কী আবৃত করেছিল সবকিছুকে? কোথায়? কার নির্দেশে?
মহাজাগতিক জল কি ছিল, অতল গভীর জল?

তখন কোনো মৃত্যু ছিল না, মৃত্যুহীনতা ছিলনা
দিন তখনও রাত্রি থেকে পৃথক হয়নি  
সেই একক শ্বাস নিচ্ছিল - বাতাস ছাড়াই, স্বয়ম্ভু
চরাচরে কোথাও ছিল না আর কিছু  

অন্ধকার ছিল সেখানে, আরো অনেক অন্ধকারকে ঘিরে-  
অপরিমেয়, নির্বিশেষ আদিম জলরাশির মতন;
তারপর জেগে উঠলো সেই একক, নির্মোক 
কারুণিক উত্তাপ জাগিয়ে তুলল তাকে 

সবার প্রথমে আবির্ভাব ঘটল কামনার,
মানসজাত সেই আদিম সৃষ্টিবীজ;  
যেসব ঋষিরা খুঁজেছেন নিজেদের অন্তরে-  
তাঁরাই জানতে পেরেছেন অস্ত্বিত্বের সঙ্গে অনস্তিত্বের সম্পর্ক 

দিগন্তবিস্তৃত রশ্মি ছড়িয়ে পড়ল মহাশূন্যে,
প্রকাশিত হল যা ছিল ওপরে, নীচে আর সবদিকে 
উর্বর সৃজনীশক্তি সক্রিয় ছিল সর্বত্র
নীচে ছিল স্থিতি আর ওপরে স্বতঃস্ফূর্ততা  

কিন্তু শেষ পর্যন্ত, কে জানে, কেই বা নিখুঁত বলতে পারে 
সবকিছু কোথা থেকে এলো, কীকরে সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল
দেবতারাও নিজেরাই এসেছিলেন সৃষ্টির পরে  
তাই কেইবা জানে ঠিক কীভাবে শুরু হয়েছিল সবকিছু 

তিনি, যার থেকে শুরু হয়েছিল সবকিছু, 
তিনি, নিজে সৃষ্টি করুন বা নাই করুন,
তিনি, যিনি উচ্চতম আকাশ থেকে লক্ষ্য করে চলেছেন 
তিনি জানেন, অথবা হয়ত তিনিও জানেননা।  





ফোটো সূত্রঃ https://www.nytimes.com/2020/01/30/science/nasa-spitzer-space-telescope.html 

Sunday 10 May 2020

আমার সব পাপ



সুচরিতা,

আমার সব পাপ আজ তোমাকে দিলাম  


যেহেতু এত বড় উপহার পৃথিবীতে 

কেউ কোনদিন দেয়নি

তাই একটু অহংকারী হও


আমার যত পাপ ছিল
দুপুরবেলার নিস্তব্ধতায় অথবা 

সবুজ জামা পড়ান  

তারা সবাই আজ দল বেঁধে

আমার বাড়ির দরজা থেকে রওনা দিল

ওরা হাততালি দিতে দিতে হাঁটছিল রাস্তার মাঝখান দিয়ে ,

পথ অপথ মানছিল না

কত খানাখন্দ ডোবা পুকুর তারা লাফ দিয়ে পার হল 

ভিক্টোরিয়ার পরীকে  তারা 

একটু জোরে ঘুরিয়ে দিল,

শ্যামবাজারের ঘোড়সওয়ারকে কি তারা 

একটা স্যালুট মেরেছিল ?

এইভাবে নানা কান্ড করতে করতে ওরা  

তোমার ব্যালকনির সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে   

 

সুচরিতা, 

আমার সব পাপ আজ গ্রহন কর  

যেহেতু এতটা আর্দ্র উপহার  পৃথিবীতে 
কেউ কোনদিন পায়নি 
তাই একটু অহংকারী হও


আমরা কি হাতগুলোকে ধরব ?


তারা ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর কোণায় কোণায়। ইন্দোনেশিয়ার সুলায়েসী দ্বীপ থেকে আর্জেন্টিনার সান্টা ক্রুজের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। দক্ষিন আফ্রিকায়, মধ্য আমেরিকার বেলিজে, ফ্রান্সে, স্পেনে। তাদের কারো বয়স ছ’হাজার বছর, কারো দশ হাজার আবার কারো বা কম করে তিরিশ হাজার।


তারা আসলে কিছু গুহাচিত্র, শুধু একটু বিশেষ  ধরনের। গুহাচিত্রের জগতে বিখ্যাত সদস্যের তো কোনো অভাব নেই। আলতামিরার গতিময় বাইসন(“আলতামিরার পর থেকে…সমস্তই ক্রম-অবক্ষয়” বলেছিলেন পাবলো পিকাসো), সোমালিয়ার লাস গীলের জামাকাপড় পরা গরুরা, উত্তর অস্ট্রেলিয়ার কাকাদু পাহাড়ের সেইসব আশ্চর্যজনক জন্তুরা শিল্পীরা ছবিতে যাদের শরীরের ভেতরের কঙ্কালকেও এঁকে দিয়েছিল, কিম্বা ফ্রান্সের লাস্কাউ গুহার “ষাঁড়দের সভাগৃহ”; তালিকাটা শেষ হবার নয়। কিন্তু তবু “তারা” অনন্য, গুহাচিত্রের জগতে একলা, দলছুট! কোনো চেনা বা অচেনা পশুযুথ নয়, শিকারের দৃশ্য নয়, তারা হলো সারিবাঁধা কিছু মানুষের হাতের ছবি। আসলে ঠিক ছবি নয়, বরং হাতের “স্টেন্সিল"। পাথরের ওপর হাত রেখে তার ওপর রং ছিটিয়ে ফুটিয়ে তোলা হাতের “নেগেটিভ”। রং মানে অবশ্যই প্রাকৃতিক সব রঞ্জক। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়েছে বাঁহাতকে, ফলে মনে করা যেতেই পারে রং ছেটানোতে ডান হাতের কোনো ভূমিকা ছিল। আদিম মানবদের (বা আরো ঠিক করে বললে মানবীদের, কারণ হাতগুলোর বেশিরভাগই সম্ভবত নারীর) এই সারিবাঁধা হাতের স্টেন্সিল ছড়ানো আছে পৃথিবীর অধিকাংশ মহাদেশের গুহাগুলোর দেওয়ালে দেওয়ালে।


আদিম মানুষরা কেন এমন চিহ্ন রেখে গেল পাথরের গায়ে? তাও আবার হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে? সাধারনভাবে গুহাচিত্র কেন আঁকাহত ঠিক করে বলতে পারেনা কেউই। তবে যাই হোক না কেন, কারণগুলো নিশ্চয়ই ছিল অনেক বেশি বস্তুনিষ্ঠ, এখন তাদের যতই রহস্যময় লাগুকনা কেন।হয়ত ভালো শিকার পাওয়ার কামনায় কিম্বা পশুদের আক্রমন থেকে রক্ষা পেতে অনুষ্ঠিত জাদু উত্সবের অঙ্গ হিসেবে ওগুলোকে আঁকা হত, কিম্বা  ওরকমই অন্য কিছু। মোটকথা কারণগুলোকেহতেই হবে মাটির কাছাকাছি, শিল্প তার জন্মলগ্নে মানুষের জীবনের সুখ দুঃখের সঙ্গে লেপ্টে ছিল এখনকার চেয়ে অনেক বেশি, এরকমই তো ইতিহাসবোধ জানায় আমাদের, তাই না? তাই যদি হয়, তাহলে ওই হাতগুলোর ব্যাখা কী? ওগুলোকেও কি আঁকা হয়েছিল এরকমই  কোনো উদ্দেশ্যে, যেমন ধরা যাক, কোনো অশুভ শক্তিকে তাড়ানোর উপায় হিসেবে? ইতিহাস নীরব এখানে, ইতিহাসবিদ কিছু “বুনো আন্দাজ”ছাড়া কিছুই সাহায্য করতে পারেননা আমাদের। আর তাই আমাদেরও কল্পনা করে নিতে আর কোনো বাধা থাকে না! এমনটা কি হতে পারে না, আদিম সেইসব নরনারী- শিকারের, আত্মরক্ষার, তাত্ক্ষণিক প্রয়োজনের ছবি আঁকতে আঁকতে হঠাত এক মুহূর্তের জন্য অস্বীকার করতে চেয়েছিল তাত্ক্ষনিকতাকে ? যে হাত মানুষকে স্বতন্ত্র করেছে তার পূর্বসুরীদের থেকে, পাথরের গায়ে সেই হাতের ছাপ রেখে দিয়ে নিজেদেরকে,মানবিকতাকে অমর করে রাখার খেয়াল চেপে বসেছিল তাদের ওপর, এক মুহূর্তের জন্য হলেও? ........কেউ জানেনা, কেউ বলতে পারবে না। 


কিন্তু শিল্প যখন সবসময়েই শিল্পীর চেয়ে অনেক বেশি চিরন্তন, কারণটা তো আর তখন এতটা গুরুত্বপূর্ণ থাকেনা। ওই হাতগুলো আঁকার উদ্দেশ্য যদি কোনদিনও জানা নাও যায় তবু ওরা অনেক কথাই ফিসফিস করে বলে যায়, বলে যাবে আমাদের কানে, আমার কানে। আমার নাছোড় একাকীত্বে, প্রতিদিনের পরাজয়ের গ্লানিতে, অপমানের  মুহূর্তগুলোতে ওদের কাছে শুনতে পাই এক অনন্য অভিযাত্রার কথা। 


এই কনক্রিটের শহরে, উদাসীন ফ্লাইওভারের তলায় দাঁড়িয়ে,  নৈর্ব্যক্তিক শপিং মলের তলায় পিষে যেতে যেতে ওই হাতগুলো আমাকে যুক্ত করে এক আবহমান মানবতার সঙ্গে। ওরা বলে যায় কী নিঃস্ব অসহায় অবস্থায়, ভয়ে  কাঁপতে কাঁপতে কুয়াশাঘেরা ভবিষ্যতের দিকে শুরু হয়েছিল মানুষের পথ চলা।বলে যায় কিভাবে আমাদের সেই আদিম পূর্বসূরিরা প্রানের তাগিদে ছুটে গেছে পাহাড় থেকে সমতলে, অরণ্য থেকে নদী অববাহিকায়, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে। কিভাবে তারা মাটি খুঁড়ে তুলে এনেছিল কন্দমূল, প্রানের বীজ, মরুভূমির মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিল সবুজকে, পরম মমতায় তৈরী করেছিল হাজার হাজার শস্যের রকমফের। আদিম রহস্যময় অন্ধকারঘেরা পৃথিবীর বুকে বসে সেই আদবকায়দাহীন মানুষেরা সৃষ্টি করেছিল সঙ্গীতকে, প্রাচীন বাতাসে মিশিয়ে দিয়েছিল বাঁশির মূর্ছনা। ওই হাতগুলো সাক্ষী থেকেছে শতকের পর শতক ধরে চলা যুদ্ধ আর বিশ্বযুদ্ধের, অরণ্য ধ্বংসের,মানুষের তৈরী দুর্ভিক্ষের আর গণহত্যার আবার সেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানুষের মহামিছিলের।সাক্ষী থেকেছে মানুষের আত্মসমর্পণের, মাথা নোয়ানোর ,অনন্ত লোভের আর হঠাত বেমক্কা ঘুরে দাঁড়ানোর মুহুর্তগুলোর। 


ফেসবুকের পাতায় দুই শিশুকে নিয়ে আত্মহত্যা করা  মায়ের ঝুলন্ত শবদেহের দিকে তাকিয়ে কিম্বা সংবাদপত্রে লক  আপে অত্যাচারিত যুবকের মুখের দিকে তাকিয়ে বিহ্বল হয়ে পড়া আমাকে, ইন্দোনেশিয়ার সুলায়েসী দ্বীপের তিরিশ হাজার বছর আগের এক মানবীর হাতের প্রতিচ্ছবি জানিয়ে দেয়, মনে রেখো “আমরা কিন্তু কখনো,  কখনো, কখনো হারিনি......”।