Sunday 3 April 2022

কালের সংক্ষিপ্ত, ব্যক্তিগত ইতিহাস


 
১। 
একজন মানুষ মারা যাবে। গাছের তলায় শুয়ে আছে সে। তাকে ঘিরে আরও কিছু মানুষ। মুমূর্ষু মানুষটি কথা বলছে। কথা বলতে গিয়ে মাঝে মাঝে জ্ঞান হারাচ্ছে। আবার সংজ্ঞা ফিরে এলে শুরু করছে। খুব আস্তে আস্তে। আশেপাশের মানুষেরা খুব মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছে। "এখনও কিছুটা সময় আছে। যদি তোমাদের কারো কিছু প্রশ্ন, সন্দেহ থেকে থাকে, কিছু জানার বাকি থেকে থাকে আমার কাছ থেকে, এখন জিগ্যেস করে নাও- যাতে পরে কোনও আপশোষ না থেকে যায়।" কোনও প্রশ্ন করল না। সবাই  মানুষটি বলল, "তোমরা হয়ত ভক্তি থেকে প্রশ্ন করছ না। আচ্ছা, আমি এবার তোমাদের একজন বন্ধু হয়ে জিজ্ঞেস করছি।" তবু কারো মুখে কথা নেই। তাড়াতাড়ি পাশ থেকে আরেকজন বলল, "ব্যাপারটা কি আনন্দের না! কারো মনে কোনও অবিশ্বাস, কোনও অস্বচ্ছতা নেই, সব সন্দেহ দুর হয়ে গেছে।" শুয়ে থাকা মানুষটি একটু হাসলেন। বললেন, "আচ্ছা, এটাই আমার শেষ কথা। যা কিছু আছে, তাইই থাকবে না। যা নেই, তাই থাকবে। তাই যত্ন নিয়ে নিজেদের রক্ষা কোরো।"  
          ২।
একজন মানুষ ধ্যান করছে। পাহাড়ের গুহায়। পাহাড়টা একটা শহরের কাছেই। মানুষটি বছরের বেশ কিছুদিন এই গুহায় ধ্যান করে কাটায়। মানুষটির মনে অনেক প্রশ্ন। সমাজ নিয়ে, সত্তা নিয়ে, সৃষ্টি নিয়ে। উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু উত্তর মেলেনা। আজও মানুষটি রাত থাকতেই গুহায় এসে ধ্যানে বসেছে। সূর্য ওঠার একটু বাকি। আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। এমন সময় মানুষটির মনে হল তার  মাথার মধ্যে কে যেন বলে উঠল, "পড়"। মানুষটি চমকে উঠল। ভয়ে ভয়ে বলল, "কিন্তু আমি তো পড়তে পারিনা"। মাথার মধ্যে থেকে আবার হুকুম এলো, "পড়"। মানুষটি আবার বললেন, "আমি তো পড়তে পারিনা"। তৃতীয়বারও একই কথা শোনা গেল। মানুষটিও একই উত্তর দিল। তারপর একটু বিরতি। অবশেষে মাথার ভেতরের কণ্ঠটি বলল, "পড়। তাঁর নামে, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একটা দলাপাকান পিণ্ড থেকে। পড়। কারণ তিনি কারুণিক। যিনি শিখিয়েছেন অক্ষর। শিখিয়েছেন যা ছিল অজানা।"  মানুষটি ভয়ে গুহা ছেড়ে নিচের শহরের দিকে দৌড়তে লাগল। হাঁপাতে হাঁপাতে নিজের বাড়িতে পৌঁছল। আরেকজন অপেক্ষা করছিল তার জন্য। মানুষটি কাঁপছে, আরেকজন তাড়াতাড়ি কম্বল নিয়ে এসে জড়িয়ে দিল তার গায়ে। মানুষটি সব ঘটনা বলল। বলল, "আমি অসুস্থ। বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি।" আরেকজন বলল, "না, তুমি আলাদা অন্যদের থেকে। আর তাই তোমাকে বাছা হয়েছে। আমি জানি।" মানুষটি তার চোখে বিশ্বাস দেখতে পেল।

 ৩ । 
একজন মানুষ একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। হাঁটছে। একটু অন্যমনস্কভাবে। পা'টা একটু কাঁপছে। সামনের চৌকো চত্বরটা পেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় লোকজন কম। এখানে ওখানে কিছু জটলা। গল্পগুজব। একজন দুজন স্থির পদক্ষেপে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মানুষটি একটু উদ্ভ্রান্ত। ফুটপাথে উঠল। একবার ডানদিকে ঘুরতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে বাঁদিকে ঘুরে গেল। ফুটপাথের পাশে একটা এক্কা দাঁড়িয়ে। মানুষটির নজর সেইদিকে নেই। এক্কাটার ঘোড়াটা বেশ বুড়ো। সহিস তাকে চালাতে চাইছে। ঘোড়াটা ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। একগুঁয়ে। অসহায়। সহিসও। চাবুক বের করল। ঘোড়াটার পা এবার থর থর করে কাঁপছে। মানুষটির দৃষ্টি ঘুরে গেছে। সহিস চাবুক ওঠাল। মানুষটি হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে ঘোড়াটার গলা জড়িয়ে ধরল। বলতে চাইল, "আমি তোমাকে বুঝেছি, বন্ধু।" ঝরঝর করে কাঁদছে। টাল সামলাতে না পেরে ওখানেই পড়ে গেল। চারপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। কৌতূহল, সমবেদনা, বিরক্তি, কৌতুক। মানুষটি বিড়বিড় করে চলেছে। একজন চেনা লোক এগিয়ে এলো। আরও কয়েকজন লোককে নিয়ে ধরাধরি করে মানুষটিকে ঘোড়ার কাছে থেকে দুরে নিয়ে গেল। মানুষটি তখনও বিড়বিড় করে চলেছে। কেউ কেউ শোনার চেষ্টা করছে। বোঝা যাচ্ছে না। কারো কারো মনে হল মানুষটি বলছে, “মা, আমি কি বোকা! মা, আমি কি বোকা!"   
  ৪।  
একজন মানুষ কাজ করতে গ্রামে গিয়েছিল। সেখানে বেশ কিছুদিন নিজের মত, খেতে খামারে, নদীতে, জঙ্গলে ঘুরে বেরিয়েছিল, আধা-চেনা অচেনা মানুষদের জীবনের ওম দূর  থেকে অনুভব করেছিল। তারপর আবার নিজের জায়গায়, চেনাশোনা লোকের মাঝে ফিরে আসা। একদিন সকালে তার মনে হল, "যেখানে বৃহৎ দৃশ্য, অসীম আকাশ, নিবিড় মেঘ, গভীর ভাব, অর্থাৎ যেখানে অনন্তের আবির্ভাব, সেখানে তার উপযুক্ত সঙ্গী একজন মানুষ- অনেকগুলো মানুষ ভারি ক্ষুদ্র  এবং হিজিবিজি। অসীমতা এবং একটি মানুষ উভয়ে পরস্পরের সমকক্ষ, আপন আপন সিংহাসনে পরস্পরের মুখোমুখি বসে থাকবার যোগ্য।"